আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটগ্রহণের আগে কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেই অহেতুক তাকে বদলি না করতে নির্বাচন কমিশনকে (ইসি) অনুরোধ জানিয়েছেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা। নির্বাচনের দায়িত্ব পালনকালে বিএনপিসহ বিভিন্ন মহল তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে পারে বলেও আশঙ্কা তাদের। এছাড়া দেশব্যাপী চলমান পুলিশের অভিযান অব্যাহত না থাকলে মাঠপর্যায়ের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার শঙ্কাও করেন আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণের কর্তাব্যক্তিরা। তবে ইসি যে দায়িত্ব দেবে তা অনুসরণ করবে বলেও জানিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
বৃহস্পতিবার নির্বাচন কমিশন ভবনের অডিটোরিয়ামে অনুষ্ঠিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ইসির বিশেষ বৈঠকে এসব কথা বলেন তারা। বৈঠকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কেএম নূরুল হুদা ছাড়াও সভায় চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিব, অতিরিক্ত সচিব, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব, আইজিপি, জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনারসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।বৈঠকে উপস্থিত ইসির একাধিক কর্মকর্তা ও পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা জাগো নিউজকে এসব তথ্য জানান।
সূত্র জানায়, কমিশন থেকে তাদের আশ্বস্ত করে বলেছে, অভিযোগ পেলেই বদলি নয়। এর আগে বিএনপির অভিযোগের প্রেক্ষিতে নির্বাচন কমিশন সচিব বলেছিলেন, ঢালাও অভিযোগ আমলে নেয়া হবে না। তবে বৃহস্পতিবার বিএনপির পক্ষ থেকে তথ্যভিত্তিক কিছু অভিযোগ জমা পড়েছে ইসিতে।
বৈঠকে জানানো হয়, ১৫ ডিসেম্বরের পর সশস্ত্র বাহিনীর একটি ছোট টিম নির্বাচনী এলাকায় যাবে। তারা পুলিশ সদস্যদের নিয়ে নির্বাচনী এলাকা রেকি করবেন। তবে, নির্বাচনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে ভোটের আগে-পরে ১০ দিন। এর মধ্যে ভোটের আগে সাতদিন, ভোটের দিনসহ পরের তিনদিন তারা মাঠে থাকবেন। কিন্তু বিচারিক ক্ষমতা নয়, স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে বিশেষ এ বাহিনী। তারা জেলা ও উপজেলা সদরে ক্যাম্প করে অর্পিত দায়িত্ব পালন করবেন।
বৈঠকে অংশ নেয়া কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা জানান, বেশিরভাগ কর্মকর্তার বক্তব্যে বদলির বিষয়টি উঠে এসেছে। তারা বলেছেন, নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করলে একটি পক্ষ বরাবরই তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করবে। এসব অভিযোগ পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত ছাড়া যেন কাউকে বদলি করা না হয়। বৈঠকে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানার ওসিকে বদলির ঘটনায় কেউ কেউ ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।
আরও জানা গেছে, বৈঠকে পুলিশের আইজি ইসিকে বলেছেন, সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আপনারা যে দায়িত্ব দেবেন তা নিরপেক্ষভাবে আমরা পালন করবো।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব বলেন, নির্বাচনে আমাদের সব বাহিনী তৎপর আছে। পুলিশ, আনসার, বিজিবি ও র্যাবের টিমগুলো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবে।
ঢাকা রেঞ্জের ডিআইজি বলেন, নির্বাচনে যেন কোনো অনিয়ম না হয় সে বিষয়ে আমরা সর্বদা সতর্ক থাকবো। তবে নির্বাচন ভণ্ডুল করার জন্য দুষ্কৃতিকারী-সন্ত্রাসীরা তৎপরতা চালাতে না পারে সে জন্য পুলিশ কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করবে।
বৈঠকে একজন পুলিশ সুপার বলেন, এই নির্বাচনে স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি মাঠে নেমেছে। ৫ জানুয়ারির (দশম সংসদ) নির্বাচন যারা বানচাল করতে সহিংসতা করেছিল তাদের অনেকেই প্রার্থী হচ্ছেন। এদের বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে ইসির নির্দেশনা চেয়েছেন তিনি।
আরেকজন পুলিশ সুপার বলেছেন, চলমান অভিযান বন্ধ করা হলে বিভিন্ন মহল মাঠে নামবে। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।
আরেক পুলিশ সুপার বলেছেন, যাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে মামলা রয়েছে তাদেরকে নির্বাচনের নামে মার্সি করা যাবে না। এ পুলিশ কর্মকর্তার বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়েছে, ফৌজদারি মামলার আসামি গ্রেফতার করা হলে ইসির আপত্তি থাকবে না। এটা আইন ও বিধিবিধান অনুসরণ করতে হবে। তবে রাজনৈতিক বিবেচনায় যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদেরকে অযথা হয়রানি করা যাবে না।
বৈঠকে আরেক পুলিশ সুপার বলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে। তবে বৈধ অস্ত্র থানায় জমা দেয়া লাগবে না। ভোটের দিন যাতে এসব বৈধ অস্ত্র প্রদর্শন না করে সে জন্য ব্যবস্থা নেয়া হবে।
একজন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বৈঠকে বলেন, রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা দেয়ার মতো পর্যাপ্ত পুলিশ সদস্য নেই। তবে তাদের নিরাপত্তায় এক-দুইজন পুলিশ সদস্য থাকবেন।
গাজীপুর-বরিশালের মতো নির্বাচন নয়: মাহবুব তালুকদার
বৈঠকে নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার চার পৃষ্ঠার লিখিত বক্তব্য পড়েন। পুলিশের উদ্দেশে দেয়া বক্তব্যে তিনি গাজীপুর ও বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে স্থানীয় প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের কার্যক্রমও তুলে ধরেন।
এ দুই নির্বাচন নিয়ে ইসির ও বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনও উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিরপেক্ষ ভূমিকা না পালন করলে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
এ কমিশনার বলেন, সরকার যদি সরকারি দলের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকে, তাহলে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা সম্ভব। ইসির পক্ষে এককভাবে লেবেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা সম্ভব নয়। তবু আমি মনে করি, সবার জন্য সমান সুযোগ তৈরি করতে পুলিশের একটি বিরাট ভূমিকা আছে।
প্রসঙ্গত, আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনে মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ দিন ২৮ নভেম্বর, মনোনয়নপত্র বাছাইয়ের দিন ২ ডিসেম্বর, প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ দিন ৯ ডিসেম্বর।