ঢাকার শ্যামলী এলাকার একটি বাড়ি। এর আশেপাশেই রয়েছে সুরম্য শপিং মল, দোকানপাট। আন্তঃনগর বাস এসে থামে এই এলাকায়। ব্যস্ত এই এলাকার ঝলমলে আলোর নিচে আছে এক অন্ধকারের গল্প।
এই রাস্তা থেকে যেসব সরু পথ ঢুকে যায় শহরের অলিন্দ ধরে তাতেই থাকে যৌনকর্মীরা। হোটেলে, বাসায় এমনকি পথেও। এই যৌনকর্মীরা নিজেরাও রয়েছে এইচআইভি ও এইডসের ঝুঁকিতে, বহন করছে একজন থেকে আরেকজনে।
বাংলাদেশ ব্যুরো অব স্ট্যাটিস্টিক্সের তথ্য মতে, ২০১৬ সালের যত মানুষ এইডসে আক্রান্ত হয়েছে তাদের মধ্যে ০.৩ শতাংশ নারী যৌনকর্মী। সংখ্যায় তারা কম হলেও এই সংখ্যাটা আশঙ্কাজনক কেন না তাদের থেকে যৌন রোগ ছড়ানোর সম্ভাবনা অনেক বেশি থাকে।
শ্যামলীর এই বাড়িটি যৌনকর্মীদের আশ্রয়কেন্দ্র। সারাদিনের ক্লিষ্ট দেহে সমাজের চোখে পতিত নারীরা এ বাড়িতে আসে বিশ্রাম নিতে, গোসল করতে, নিজেদের মধ্যে কিছুটা সময় কাটাতে—রাতের আধারে যারা এই শহরের মনোরঞ্জনের পণ্য দিনের আলোতেই তাদের চিনতে চায় না কেউ। একটি স্থানীয় এনজিও ও আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার সহযোগিতায় চলে এ বাড়িটা। এখান থেকে তাদের কনডম দেওয়া হয়, শিক্ষা দেওয়া হয়, তাদের জন্য একজন চিকিৎসক পর্যন্ত আছেন। সহযোগিতা দেওয়া হয় সামাজিক নিরাপত্তার, এমনকি যদি কোনো বিপদ হয় তা থেকে রক্ষার কাজটাও করে থাকে এ বাড়িটি; ওরা একে জানে ড্রপ ইন সেন্টার নামে। বিনিময়ে তারা চেষ্টা করে এইচআইভি ও এইডস থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে এবং তাদের ক্লায়েন্টদেরও নিরাপদে রাখতে।
দেশের ১২টি জেলায় এরকম ২৯টি ড্রপ ইন সেন্টার আছে। এখানে সারাবাংলার কথা হয় সালিমা সুলতার সঙ্গে। তিনি সেভ দ্য চিল্ড্রেনের পক্ষ থেকে এইসব ড্রপিং সেন্টারগুলোর দায়িত্বে আছেন। সালিমা বলেন, বাংলাদেশে প্রায় ১ লাখ নারী যৌনকর্মী আছেন—যাদের মধ্যে মাত্র ২৮ শতাংশকে নিয়ে কাজ করছেন তারা। এই ২৮ শতাংশের বাস্তবতাও বেশ করুণ।
মেয়েটির নাম রিয়া (ছদ্মনাম), দেখলেই বোঝা যায় বয়স এখনও আঠারো পেরোয়নি। যদিও তার দাবি সে এখন প্রাপ্তবয়স্ক। বছর পাঁচেক আগে দক্ষিণ বঙ্গের একটি জেলা থেকে ঢাকায় এসেছিল চাচার হাত ধরে, কিন্তু সহসাই বেহাত হয়ে যায়। এরপরের গল্প বহুশ্রুত, শুধু উন্নতি হয়নি বাস্তবতার।
সালিমা বলেন, আমরা যাদের নিয়ে কাজ করি তাদের একটা বড় অংশের বয়সই ১০ থেকে ১৮-এর মধ্যে। এবং তাদের মধ্যেও ৮১ শতাংশ জীবনে কোনো এক সময় বিবাহিত ছিল। এই পেশায় জীবন টেনে এনেছে তাদের।
সালিমারা এখানে কাজ করেন এই মেয়েদের জীবনটাকে কিছুটা হলেও সহজ করার। এতে কী সহজ হয় তাদের জীবন? এত সহজেই দেওয়া যায় না এই প্রশ্নের জবাব।
একজন যৌনকর্মী আমেনা (ছদ্মনাম) সারাবাংলাকে বলেন, আমাদের পেশার কোনো ঠিক করা নিয়ম নেই। ক্লায়েন্ট যা বলেন আমরা মানতে বাধ্য হই। আমরা বড়জোর তাদের বলতে পারি কনডম ব্যবহার করার কথা, তারা তা শুনবেই কি না আমরা নিশ্চিত করতে পারি না। অনেক সময় তারা কনডম ব্যবহার না করার জন্য আমাদের বেশি টাকা দেয় যেটাকে আমরা সব সময় ‘না’ করতে পারি না।
সালিমা বলেন, যৌনকর্মীদের মধ্যে কনডম ব্যবহারের সচেতনতা প্রায় ৭০ শতাংশ, কিন্তু প্রতিবার যৌনকার্যে কনডম ব্যবহারের সম্ভাবনা মাত্র নয় শতাংশ। এখান থেকেই বোঝা যায় যৌনকর্মীদের অসহায়ত্বটা।
তিনি আরও বলেন, ওদের জীবনের বাস্তবতা আমাদের থেকে আলাদা। হয়তো আজকে কারও খুব জরুরি প্রয়োজনে টাকা লাগবে, শিশুর খাবার নেই, বাড়িভাড়া দেওয়া হয়নি। টিকে থাকার এই ছোট ছোট যুদ্ধে ওরা তখন এইচআইভির বড় যুদ্ধটা দেখতে পায় না। ফলে বাড়িয়ে ফেলে এইডসের ঝুঁকি।
এই ড্রপ ইন সেন্টারগুলোতেই কাজ করেন কিছু নারী, যারা পেশায় যৌনকর্মী কিন্তু একই সঙ্গে কাজ করেন যৌনকর্মীদের এইচআইভি ও এইডস সম্পর্কে সচেতন করতে। তারাই এই সেন্টারগুলোর প্রাণ। দিন নেই রাত নেই তারা ছুটে যান যৌনকর্মীদের যেকোনো প্রয়োজনে। হয়ত কারও কনডম লাগবে, কেউ শারীরিকভাবে আহত হয়েছে, কেউ অকারণেই রোষের মুখে পড়ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর। শুধু একটা ফোন কলের দূরত্ব। ছুটে যাচ্ছেন তারা একে অন্যের জন্য।
প্রতিটা ড্রপ ইন সেন্টারে এরকম আট-দশজন কর্মী থাকেন। প্রত্যেকে অন্তত ৯০ জন যৌনকর্মীকে রক্ষার কাজ করে থাকেন। তাদেরই একজন মাহফুজা (ছদ্মনাম) বলেন, রাস্তার কাজে (যৌনকাজ) আছি ১৮ বছর। এই ১৮ বছর ধরেই আমি কাজ করছি এইচআইভি ও এইডসের সচেতনতায়।
এত ব্যবস্থা রাখার পরেও এইচআইভি ছড়ায় যৌনকর্মীদের মধ্য দিয়ে। আর তা বন্ধ করার কাজটাও বেশ দুরূহ। ড. রহিমা এই ড্রপিং সেন্টারটির চিকিৎসক। তিনি বলেন, এইডস রোগটি একটা নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ছড়ায় যেই নেটওয়ার্কের থাকা প্রতিটি মানুষকে সচেতন করা বা চিকিৎসার আওতায় আনার কষ্টসাধ্য।
যেসব নারীরা যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করে তারা ভাবেন স্বামীর যৌন মেলামেশায় হয়তো তাদের কনডম ব্যবহার করতে হবে না। কিন্তু তাদের স্বামীরাও এইচআইভি পজেটিভ হতে পারে। আমরা চেষ্টা করি প্রতিটি যৌনকর্মীর নেটওয়ার্কে থাকা প্রতিজনকে পরীক্ষা করতে এবং তাদের এইডস সম্পর্কে সচেতন করতে। এখানে এসে স্বামী বা ক্লায়েন্টরা এইচআইভি টেস্ট করতে পারেন। কেউ কেউ আসেন কেউ আসেন না, বলেন তিনি।
ড. রহিমা আরও বলেন, একবার আমরা একজন এইচআইভি পজেটিভ যৌনকর্মী পেয়েছিলাম যার ক্লায়েন্টকে এনে পরীক্ষা করানো হয়েছিল। কথা ছিল তিনি তিনমাস পর আবার এসে পরীক্ষা করাবেন যেন নিশ্চিত হওয়া যায় তার শরীরে এইচআইভি পজেটিভ কি-না। কিন্তু তিনি এই জায়গা থেকে চলে গিয়েছেন। শুনেছি তিনি অন্য কোথাও গিয়ে বিয়েও করেছেন, ফলে আমরা আর নিশ্চিত হতে পারনি তিনি আদৌ ঐ রোগে আক্রান্ত হয়েছেন কি-না এবং এই সময়ের মধ্যে তিনি রোগের বিস্তার ঘটাচ্ছেন কি না!